পলিসি বিতর্কঃ বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলনের দায়

গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম

সাবেক সহ সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি

আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশের বিতার্কিকদের মধ্যে সংসদীয় বিতর্কের বিষয়ের শ্রেণীকরণ নিয়ে ‘প্রিন্সিপল ডিবেট’ বনাম ‘পলিসি ডিবেট’ শীর্ষক এক ধরনের বহুল আলোচিত মতদ্বৈততা ছিল! তা নিয়ে বহুধাবিভক্ত মতামত ছিল বিতার্কিক, বিচারক ও বিতর্কবোদ্ধা সবারই। পরবর্তীতে অনেক ভেবে দেখেছি যে এই ধরনের শ্রেণীকরণের তেমন যৌক্তিকতা নেই আসলে। যে পার্লামেন্টের মডেলে আমরা ছায়া সংসদে দাঁড়িয়ে বিতর্ক করে থাকি সেই ওয়েস্টমিন্সটার ধাঁচের সত্যিকার সংসদে সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক মৌলিক কিছু নীতি ও দর্শন থাকে। সেগুলোর ভিত্তিতেই তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো রচিত হয়, ক্ষমতায় এলে আইন প্রণয়ন কিংবা বিরোধী দলে থাকলে সরকারি নীতির বিরোধিতা ও খন্ডন সেই ‘প্রিন্সিপল’ এর আলোকেই তারা করে থাকে। সুতরাং ‘প্রিন্সিপল’ আর ‘পলিসি’কে আলাদা করে বিতর্কের বিষয়ের শ্রেণীকরণ করে আসলে লাভ নেই, প্রতিটি ‘পলিসি’ প্রস্তাবিত ও প্রণীত হয় এক বা একাধিক ‘প্রিন্সিপল’কে ভিত্তি করেই, আবার প্রতিটি ‘প্রিন্সিপল’ আর্থ-সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা পায় বিস্তৃত হয়ে সুনির্দিষ্ট ‘পলিসি’তে অনূদিত হলেই। সংসদীয় বিতর্কের ব্যাকরণ সংক্রান্ত সেইসব প্রায় তামাদি মতদ্বৈততার অবতারণা এই লেখার বিষয় নয়। ‘পলিসি বিতর্ক’ সংক্রান্ত শিরোনামে যাতে বিতর্ক সংশ্লিষ্ট পাঠক ভেবে না বসেন যে আমি আবার সেই ‘প্রিন্সিপল বনাম পলিসি’ সংক্রান্ত পুরনো তর্ক ফিরিয়ে আনছি সেজন্যেই ভূমিকায় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভব করলাম।
এই লেখায় যে ‘পলিসি’ সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে কথা বলতে চাই তা বিতার্কিকদের ছায়া সংসদের প্রস্তাবিত বিল নয়, বাস্তবে সংসদে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের জনগণের জন্য যে আইন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করেন সেই ‘পলিসি’। ‘পলিসি’ শব্দটির বিভিন্ন বাংলা অর্থ করা যেতে পারে, তবে প্রচলিত অর্থে নীতি, শাসনপ্রণালী ও রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মপন্থা অর্থে একে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই লেখায় বোঝার সুবিধার্থে তাই ইংরেজি ‘পলিসি’ই ব্যবহার করছি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রণীত এবং বাস্তবায়িত যে কোন ধরনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ‘পলিসি’ই সরাসরি আমাদের তথা জনগনের জীবনকে অল্প কিংবা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত করে। বার্ষিক বাজেট, কর থেকে শুরু করে সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত প্রতিটি নীতি ও কর্মপরিকল্পনা দ্বারা আমাদের বর্তমান দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে সুদূর ভবিষ্যত এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের জীবনধারাও প্রভাবিত হয়। তাই ‘পলিসি’ কেবল জনপ্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটি কিংবা সমাজের উপরিতলার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ যারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের বিষয় নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কন্ঠস্বর ও আশা যদি নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত না হয় তাহলে তা সমাজের জন্য দুর্ভোগই ডেকে আনে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সংসদীয় ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজ নিজ অঞ্চলের জনগণের চাওয়া পাওয়া ও যুক্তি সংসদে অনুষ্ঠিত ‘পলিসি’ বিতর্কগুলোতে তুলে ধরা, তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে সেইসব যুক্তিতর্ক অনুসারে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
কেতাবি এই সংসদীয় পলিসি বিতর্কের সংস্কৃতি আমাদের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করে না, কারণ এখানে অভিজাত নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার হিসাব দরিদ্র সাধারণ জনগণ বিভিন্ন কারণেই মিটিয়ে নিতে পারে না। তাই সেই দায়িত্ব পালন করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হয় গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটিকে। সমাজের শিক্ষিতশ্রেণী ও সচেতন মধ্যবিত্তই নিরন্তর প্রশ্ন উত্থাপন করে ও জবাবদিহিতা দাবি করে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব কার্যকর এবং জনমুখী করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সংসদের বাইরে গণমাধ্যম ও সমাজের সচেতন শ্রেণীর উত্থাপিত যুক্তিতর্কই তাই এখানে ‘পলিসি বিতর্ক’ চালু রাখার ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা আদায়ের বাস্তবসম্মত উপায়।
দুঃখজনক ব্যাপার হল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর কোনটিই তেমনভাবে কাজ করছে না। ১৯৯০ এর পর সংসদীয় গণতন্ত্রের ট্র্যাকে উঠে যখন রাষ্ট্রের নতুন যাত্রা শুরু হল তখন আমরা আশা করেছিলাম সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাণবন্ত বিতর্ক, গণমাধ্যমে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সিভিল সোসাইটির তীক্ষ্ণ নজরদারির মধ্য দিয়ে আমাদের পলিসি বিতর্ক ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠবে। একই সাথে এগিয়ে যাবে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মত ‘পলিসি বিতর্ক’কে আমরাও ছড়িয়ে দেবো তৃণমূলে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রান্তিক জনগনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবে প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষ, শিক্ষা ও সচেতনতার বিস্তারের সাথে সাথে। শুধুমাত্র একদিনের ব্যালটের মাধ্যমে নয় বরং ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে অংশগ্রহণমূলক নীতিপ্রণয়নের সংস্কৃতি। কিন্তু তা হয়নি। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ অভিজাতদের হাতে চলে গেছে, জবাবদিহিতা ও বিতর্কের সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সংসদে তাই চলেছে বিতর্কের বদলে বয়কট, যুক্তির বদলে শক্তিপ্রয়োগ ও সহিংসতা হয়েছে রাজনীতির মূলভিত্তি। স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিবিদরা জনপ্রতিনিধি না হয়ে বরং হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক।
সেই দায় সমাজের নানা অংশের ওপর কমবেশি বর্তায়, বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদেরও তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নব্বইয়ের শুরুতে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজ কেন্দ্রিক যে সাংগঠনিক বিতর্ক চর্চা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী প্রজন্মের নাগরিকদের যুক্তিমনস্ক করে গড়ে তোলা এবং বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে সমাজে ও রাজনীতিতে যুক্তিচর্চার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়া। আজ দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলন প্রায় আড়াই দশকের সেই প্রচেষ্টায় মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। এর একক দায় হয়তো শুধু বিতার্কিকদের নয়, সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতায় বিতার্কিকরা আক্রান্ত হবেন না এই আশা দুরাশাই বটে। কিন্তু সমাজের অন্যান্য অংশের চেয়ে যুক্তিচর্চা ও মননশীলতায় এগিয়ে থাকা বিতার্কিকদের কাছে রাষ্ট্রের প্রাপ্য ছিল অনেক কিছুই। বিতর্ক আন্দোলনের সাথে দেড় দশকের ব্যক্তিগত পথচলার পর আজ নিজেকে যখন প্রশ্ন করি যে সেই দায় আমরা পূরণ করতে পেরেছি কিনা, তখন নেতিবাচক উত্তর ব্যতীত অন্য কিছু পাই না।
অথচ বিতর্কের চর্চা বেড়েছে, সংখ্যা ও আকারে বিতর্ক আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছে। আপেক্ষিক বিধায় মানের প্রশ্ন উত্থাপন করলে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া কঠিন, তাই সেই প্রসঙ্গ নাহয় নাই তোলা হল। দুই প্রজন্মের বিতার্কিকরা ছাত্রজীবনের সাংগঠনিক চর্চা পেরিয়ে জাতীয় পরিসরে নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু বিতর্ক আন্দোলন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জনগণের জন্য আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি তার অন্যতম কারণ সত্যিকার ‘পলিসি বিতর্ক’ বিতর্ক চর্চায় ও প্রসারে বিতার্কিক ও সংগঠকরা ব্যর্থ হয়েছেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার কলেবর ও জাঁকজমক বেড়েছে, গণমাধ্যমে প্রচার প্রসার হয়েছে, কিন্তু ছায়া সংসদের ছেলেমানুষি পক্ষ বিপক্ষের তর্কের বাইরে যেসব নীতিনির্ধারণী বিষয় প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে তা নিয়ে জনগনের প্রতিনিধিত্বশীল কন্ঠস্বর বিতার্কিকরা হয়ে উঠতে পারেননি। সাংগঠনিক বিভক্তি ও রাজনৈতিক বলয়কেন্দ্রিক মেরুকরণে বিভক্ত হয়ে যাওয়াও ব্যর্থতার পেছনে নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
একই কথা আমাদের বিভক্ত সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও খাটে। রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে পলিসি বিতর্ক প্রসার ও তাতে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রটি আমাদের গণমাধ্যম ও এনজিওকেন্দ্রিক সিভিল সোসাইটি প্রসারিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘অল্টারনেটিভ পিপলস মিডিয়া’ তথা সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক গণমাধ্যমেও সেই প্রবণতার বিস্তারই দেখি। অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক তর্ক নিয়ে যুক্তিহীন আলাপে আমরা সর্বত্র ব্যস্ত, অথচ আমাদের জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার প্রতিটি মৌলিক চাহিদা ও অনুষঙ্গ কিংবা রাষ্ট্রের উন্নয়নকৌশল নিয়ে ‘পলিসি বিতর্ক’ বলতে গেলে কোথাওই নেই। ফলে ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ ও অভিজাতদের পক্ষে সহজ হয়ে যাচ্ছে তাদের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার। গত চার দশকে সমাজে ক্রমশ উর্ধ্বগামী অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র দেখলেই বোঝা সহজ হয় যে অবান্তর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কুতর্কের বায়োস্কোপে আমাদের ব্যস্ত রেখে পলিসি বিতর্কের অনুপস্থিতির সুযোগে আর্থ-সামাজিক নীতিনির্ধারণগুলো কোন সামাজিক শ্রেণীর সুবিধার্থে করা সম্ভব হয়েছে। অকার্যকর সংসদ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গত এক দশকে যে বহুমাত্রিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে তা আমাদের রাজনীতিতে ও শাসনকার্য পরিচালনায় বিতর্কের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার পথ রুদ্ধই করছে দিন দিন।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিতর্ক আন্দোলন তাহলে কি ভূমিকা রাখতে পারে? ব্যর্থতার হাহুতাশ নয় বরং সমাধান ও উত্তরণের পথ খোঁজাই সুবিবেচনার পরিচায়ক। বিতর্ক আন্দোলন তথা বিতার্কিক ও সংগঠকরা এই মুহূর্তে তাই পলিসি বিতর্কে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সংগঠিত শক্তিশালী ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। গতানুগতিক প্রতিযোগিতা আর অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক বিতর্কচর্চার বাইরে গিয়ে জাতীয় নীতিনির্ধারণী ইস্যুগুলোতে রাজনীতিবিদ, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, তরুণ সমাজ ও সাধারণ জনগণকে এক টেবিলে নিয়ে আসার কার্যকরী ফরম্যাট খুঁজে নিতে হবে বিতার্কিকদের, শুরু করতে হবে তার যথার্থ প্রয়োগ। একাত্ম করতে হবে নানা পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাবেক বিতার্কিকদের, যারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজের নানা ক্ষেত্রে অর্জন করেছেন গ্রহণযোগ্যতা। একাডেমিয়া থেকে প্রশাসনযন্ত্র, সিভিল সোসাইটি থেকে তৃণমূল রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সর্বস্তরে বিস্তৃত করতে হবে পলিসি বিতর্কের সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে বিতর্ক সংগঠন, সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম হতে পারে পরস্পর পরিপূরক মিত্র। তবে বর্তমানের প্রচলিত আঙ্গিকে নয়, যেখানে জাতীয় ও বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব ইস্যুতে বিতর্ক সংগঠনগুলোর সাথে আয়োজন করে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আর বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম থাকে তথাকথিত মিডিয়া পার্টনার। সেখানে আয়োজনের ঢাকঢোল থাকে, প্রতিযোগিতার উৎসবমুখর আবহ থাকে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এসবের কোন দৃশ্যমান প্রভাব দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত। পলিসি বিতর্ক হতে পারে একেবারেই আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত, হতে পারে রাজপথে, সাধারণ মানুষের ভিড়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে। অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নতত্ত্বে নীতিনির্ধারণ ও কৌশল প্রণয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ‘হ্যান্ডওভার দ্যা স্টিক ট্যু পিপল’ নামক বহুল প্রচলিত স্লোগান এক্ষেত্রে বিতার্কিকরা রূপান্তরিত করতে পারে ‘হ্যান্ডওভার দ্যা মাইক্রোফোন ট্যু পিপল’ এ। অংশগ্রহণমূলক পলিসি বিতর্কের অন্যতম ভিত্তি হল জনগনের কথা শোনা ও তা ফিল্টার করে সারসংক্ষেপ তৈরি করে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া, তার উপর নির্ভর করে জনমত তৈরির চেষ্টা করা। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে তা রূপ নেয় পলিসি এডভোকেসিতে, বিতার্কিকরা তাই দায়িত্ব নিয়ে হয়ে উঠতে পারে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পলিসি এডভোকেট।
আড়াই দশকের সাংগঠনিক পরিক্রমায় বিতর্ক সংগঠনগুলোর এতদিনে পলিসি বিতর্ক প্রসারে জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের মাঝে সংযোগকারী সেতু হয়ে উঠবার কথা ছিল, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাবে যা এখনো হয়ে ওঠেনি। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারে আজ সুযোগ এসেছে বর্ধিত কলেবরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণমূলক পলিসি বিতর্কের সংস্কৃতি রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার। কার্যকরী বিভিন্ন ফরম্যাটের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক বিতর্কের অভিনব নতুন নতুন মডেল উদ্ভাবনের দায়িত্বও বিতার্কিকদেরই নিতে হবে। যেসব পলিসি আমাদের জীবনকে বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে যুক্তিতর্ক হতে হবে সর্বত্র, টেলিভিশন পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে শিক্ষায়তন হয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে ও অনলাইনে বিকল্প প্ল্যাটফর্মে। গতানুগতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার অনুর্বর চর্চা থেকে তাই দ্রুত বেরিয়ে এসে উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন কিছু করার সময় আজ বয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাতীয় নীতি নির্ধারণে সংসদীয় ব্যবস্থায় যুক্তি ও বিতর্কের যে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে গত দুই দশকে তা তৃণমূল জনগণের চাপ ও নতুন করে পলিসি বিতর্কের প্রসার ব্যতীত নীতিনির্ধারণের সর্বোচ্চ স্তরে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সুশাসনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি অংশগ্রহণমূলক পলিসি বিতর্ককে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার অন্যতম দায় বিতর্ক আন্দোলনের। যে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে নব্বই উত্তর সাংগঠনিক বিতর্ক চর্চার প্রসার বিস্তৃতি, তা পূরণই আমাদের বিতর্ক আন্দোলনকে দেবে পরিণত রূপ। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রান্তিকালে বিতার্কিকদের তাই নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগ নেই আর।

ডিবেট ফর হিউম্যানিটি - ডিএফএইচ

৩৫৫/১ (৪র্থ তলা), দিলু রোড, মগবাজার, রমনা, ঢাকা – ১২১৭, বাংলাদেশ

যোগাযোগ
৩৫৫/১ (৪র্থ তলা), দিলু রোড, মগবাজার, রমনা, ঢাকা – ১২১৭, বাংলাদেশ

টেলিফোন
০১৬৭৪৬৪৪৫৯৯, ৮৮০-২-৯৯৯৯৯৯

ফ্যাক্স
৮৮০-২-৯৯৯৯৯৯

ই-মেইল
debateforhumanity@gmail.com